ইব্রাহিম খলিল মামুন, সমকাল :
জাহাজ থেকে নেমে জেটি দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঢুকতেই দেখা গেল বাজারঘেঁষে ডেইল পাড়ায় নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। প্রায় ২০ কাঠা জমিতে ইতোমধ্যে দুই তলার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, ভবনটিতে অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল আবাসিক হোটেল নির্মাণ করা হচ্ছে। এখনও নাম দেওয়া হয়নি। ঢাকার এক ব্যক্তি হোটেলটি নির্মাণ করছেন।
ভবনটির মালিক পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ তদারকি করছেন রিয়াজ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি।
তিনি জানান, তিন মাস ধরে তিনি নির্মাণকাজ তদারকি করছেন। এ সময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়নি।
একইভাবে পূর্ব পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। ইতোমধ্যে ভবনটির এক তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। স্থানীয় সৈয়দ আলম ভবনটির মালিক।
সৈয়দ আলম জানান, এ ইকো রিসোর্টের নির্মাণকাজ এক বছর আগে তিনি শুরু করেন। আর্থিক সংকটে আপাতত নির্মাণ বন্ধ রয়েছে।
সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘুরে এ ধরনের ২৭টি হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ নির্মাণাধীন দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০টিই বহুতল ভবন। এ ছাড়া সেমিপাকা স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে আরও সাতটি। এসব ভবন পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই প্রকাশ্যে নির্মিত হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের ১৩টি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) একটি সেন্টমার্টিন। এ অর্থ হলো দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে, এমন কোনো কাজ সেখানে করা যাবে না। এ কারণে সেন্টমার্টিনে স্থাপনা নির্মাণে ছাড়পত্র দেয় না পরিবেশ অধিদপ্তর।
এসব স্থাপনা এমন সময় নির্মাণ করা হচ্ছে, যখন সেন্টমার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সরকার দ্বীপে পর্যটক সীমিতকরণের কাজ করছে। পাশাপাশি সেখানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দ্বীপের হোটেল মালিক সমিতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সেন্টমার্টিনে বহুতল ও এক তলা মিলিয়ে হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা আড়াইশর বেশি। এর মধ্যে গত দুই বছরে তৈরি হয়েছে ১৩০টি। ২৭টি নির্মাণাধীন আছে। পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, একটি স্থাপনা নির্মাণেও তাদের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।
সেন্টমার্টিনে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ঠেকানোর কাজটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে দ্বীপটিকে রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কক্সবাজারে জেলা প্রশাসন ও টেকনাফে উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয় রয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপেই পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি কার্যালয় আছে, পুলিশ ফাঁড়ি আছে। কিন্তু সবার চোখের সামনেই দ্বীপটিতে নির্মাণসামগ্রী নেওয়া হয়; নির্মাণকাজ চলে; হোটেল ও রিসোর্ট উদ্বোধন হয়; পর্যটকরা যান; ব্যবসা হয়– কিন্তু কেউ বাধা দেন না।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ সোলাইমান হায়দার বলেন, তিনিও শুনেছেন, বেশ কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। শিগগিরই পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হবে।
দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, নির্জন সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়াবন উজাড় করে অবকাঠামো তৈরি, গভীর রাত পর্যন্ত সংরক্ষিত এলাকায় আলোকসজ্জা, লোকজনের হইচইয়ে ডিম পাড়তে আসতে পারছে না মা কচ্ছপ। এলেও কচ্ছপের ডিম খেয়ে নিচ্ছে কুকুর। সৈকতের বালুচর দিয়ে পর্যটকবাহী ইজিবাইক (টমটম) ও মোটরসাইকেল চলাচল করে। ফলে শামুক, ঝিনুক, লাল কাঁকড়াসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
দ্বীপের পরিবেশকর্মী আব্দুল আজিজ বলেন, সাধারণত ডিসেম্বর থেকে সৈকতে মা কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এ মৌসুমে কচ্ছপ তেমন একটা চোখে পড়েনি। এটা অশনিসংকেত।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে সরকার সেন্টমার্টিনে পর্যটক সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি– এ চার মাস সেখানে পর্যটক সীমিত থাকবে। নভেম্বরে পর্যটকরা যেতে পারবেন, কিন্তু রাত যাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন না। ফেব্রুয়ারি মাসে সেন্ট মার্টিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে পর্যটক যাওয়া বন্ধ রাখা হবে।
ভ্রমণনিষিদ্ধ এলাকায়ও রিসোর্ট
সেন্টমার্টিনের গলাচিপা থেকে দিয়ারমাথা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ। কারণ সেখানে কচ্ছপ ডিম পাড়তে যায়। এ নিষিদ্ধ এলাকায়ও ৩০টির বেশি দোতলা রিসোর্ট ও কটেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে কোরাল মুন রিসোর্ট, মেরিনা, মিউজিক রিসোর্ট, অরণ্য, এলিফ্যান্ট ইকো রিসোর্ট, গোধূলি, দীপান্বিতা, দ্বীপান্তর, জ্যোৎস্নালয়, সিংসুক, সায়েরী, স্যান্ডক্যাসল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, সূর্যবান, বেলা ভিসতা, সানসেট, সেরেনিটি, সিনবাদ রিসোর্ট উল্লেখযোগ্য।
সেন্টমার্টিনের জেটি থেকে ভ্রমণনিষিদ্ধ এলাকার রিসোর্টগুলোতে পর্যটকের যাতায়াতে চলাচল করে শতাধিক ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম)। রয়েছে মোটরসাইকেল ও নৌযান। সেসব যানবাহনে চড়ে পর্যটকরা নিষিদ্ধ এলাকায় যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি এইচ এম এরশাদ বলেন, সেন্টমার্টিনে যে অবৈধ হোটেল-রিসোর্ট নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা প্রশাসনের কারও অজানা নয়। তারা অবৈধ সুবিধাভোগীও।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দীন বলেন, দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তিনি সবকিছু করবেন।
প্রাণপ্রকৃতিতে সমৃদ্ধ দ্বীপ
সেন্টমার্টিন দ্বীপে যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ও হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্য ফেলা হয়। বড় উদ্বেগের দিক হলো দ্বীপে কেয়াবন উজাড় করে হোটেল-রিসোর্ট হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। ২০২০ সালে সেন্টমার্টিন নিয়ে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নাল-এ প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, পদক্ষেপ না নিলে ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-